ঢাকা , সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ , ২০ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

​বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে বকেয়া ৪৭ হাজার কোটি টাকা

আপলোড সময় : ০২-০২-২০২৫ ০২:০৩:৫৪ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ০২-০২-২০২৫ ০২:০৩:৫৪ অপরাহ্ন
​বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে বকেয়া ৪৭ হাজার কোটি টাকা
তিন বছর ধরে নিয়মিত বকেয়া অর্থ পরিশোধের চাপে আছে দেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রেখে যাওয়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিপুল বকেয়া বিল অন্তর্বর্তী সরকার কিছুটা পরিশোধ করলেও, এর লাগাম টানা যাচ্ছে না। বর্তমানে এই খাতে বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা।

এর মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাওনা প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর বকেয়া প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। কোম্পানিগুলো দ্রুত পাওনা পরিশোধে সরকারকে তাগাদা দিচ্ছে। সময়মতো পাওনা অর্থ না পেলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বিঘ্নিত হতে পারে বলে সতর্ক করে তারা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগে চিঠি দিয়েছে। বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপ্পা) প্রতিনিধিরা গত ৮ জানুয়ারি পাওনার বিষয়ে বিদ্যুৎ সচিব ফারজানা মমতাজের সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি।

করছাড়, ভর্তুকি মূল্যে জ্বালানি আমদানি, উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ (রেন্টালভাড়া), প্রকল্পের জমি, ঋণগ্রহণে সহযোগিতাসহ সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছেন বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা। তিন-পাঁচ বছর মেয়াদি ব্যয়বহুল ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর চুক্তির মেয়াদ একাধিকবার বাড়িয়েছে সরকার। এর আগে বেসরকারি কেন্দ্রের মালিকরা ফার্নেস অয়েলের আমদানি শুল্ক কমানো ও বকেয়া বিলের ওপর সুদ দাবির পাশাপাশি ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের ওপর ১০-১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের দাবি করেছিলেন। পাশাপাশি ডলারের মূল্যবৃদ্ধির আবদার করেন বেসরকারি মালিকরা। যদিও দেশীয় প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বে¡ও তাদের ডলারের হিসাবে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয় সরকারকে।

বকেয়া পরিশোধের বিষয়ে বিদ্যুৎ সচিব ফারজানা মমতাজ বলেন, ‘এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। ইতিমধ্যে আস্তে আস্তে কিছু বকেয়া শোধ করা হয়েছে। অর্থ বিভাগ থেকে যে পরিমাণ অর্থছাড় হচ্ছে, সে অনুযায়ী আমরাও পেমেন্ট দিচ্ছি। শিগগির আরও কিছু পেমেন্ট পাব বলে আশা করছি। তা দিয়ে গ্রীষ্মে বিদ্যুতের জরুরি চাহিদা মেটাতে যেখানে দেওয়া দরকার দেওয়া হবে।’

গত মাসে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম বলেন, ‘পিডিবির কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই পাওনা ১০ হাজার কোটি টাকা। বকেয়ার কারণে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারছি না। সরকারের কাছে আপাতত আমরা ৩ হাজার কোটি টাকা চেয়েছি। এখন এই টাকা না পেলে আসন্ন গ্রীষ্মে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে না। এর ফলে দুই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোডশেডিং হতে পারে।

এ বিষয়ে বিপ্পার সভাপতি ও মিডল্যান্ড পাওয়ারের চেয়ারম্যান ডেভিড হাসনাত বলেন, ‘পাওনা পরিশোধের জন্য পিডিবির চেয়ারম্যান এবং সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। কিন্তু কবে টাকা পাওয়া যাবে, তার নিশ্চয়তা মেলেনি। পিডিবির চেয়ারম্যান সর্বশেষ জানিয়েছেন, টাকা জোগাড় করতে পারলে তবেই বকেয়া পরিশোধ করবেন তারা।’

এদিকে ভারতের আদানি গ্রুপের বকেয়া দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। কোম্পানিটি গত ১৯ জানুয়ারি পিডিবিকে পাঠানো এক চিঠিতে আগামী জুনের মধ্যে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বকেয়া বিল শোধ করার সময় বেঁধে দিয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে বকেয়া দিলে বিলম্ব ফি মওকুফ করার প্রস্তাব করেছে আদানি। পাওনা নিয়ে গত আগস্টের পর থেকে আদানির সঙ্গে অন্তর্র্বর্তী সরকারের টানাপড়েন চলছে। পাওনা আদায়ে নভেম্বর থেকে একটি ইউনিটের উৎপাদন আদানি বন্ধ রাখে। যদিও আদানির কেন্দ্রের কয়লার বিল নিয়ে বিরোধ আছে। এটি এখনো সুরাহা হয়নি। তারা কয়লার বাড়তি দামে বিল জমা দিলেও পিডিবি বাজার দামে হিসাব করছে।

সংকটে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা। চীন ও বাংলাদেশের যৌথ মালিকানার এই কেন্দ্রটির পিডিবির কাছে পাওনা প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা; রামপাল, এস আলম, মাতারবাড়ীসহ বিভিন্ন কেন্দ্রের বকেয়া প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।সময়মতো অর্থ না পেলে কয়লা ও জ্বালানি তেল আমদানি ব্যাহত হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর উৎপাদন ব্যাহত হলে গরমে প্রচণ্ড লোডশেডিং হবে।

এদিকে বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন গ্যাস বিক্রি বাবদ পেট্রোবাংলার কাছে প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা পাবে। এ অর্থ পরিশোধে সম্প্রতি জ্বালানি বিভাগে তারা চিঠি দিয়েছে। শেভরন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এরিক এম ওয়াকার চিঠিতে বকেয়ার অন্তত ৯০০ কোটি টাকা দ্রুত পরিশোধের অনুরোধ জানিয়েছেন।

শেভরন জানিয়েছে, সময়মতো অর্থছাড় না হওয়ায় তারা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আনতে পারছে না। এতে গ্যাস উৎপাদন বিঘিœত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানাসহ জালালাবাদ ও মৌলভীবাজার ক্ষেত্র পরিচালনা করে। এর মধ্যে বিবিয়ানা থেকেই দৈনিক সরবরাহ করা দেশীয় গ্যাসের (১৯৩ কোটি ঘনফুট) প্রায় অর্ধেক (৯৭ কোটি ঘনফুট) উত্তোলন করা হয়।এদিকে আমদানি করা এলএনজি বাবদ বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা পাওনা দাঁড়িয়েছে।

গ্যাস নিয়েও ভোগান্তি বাড়বে : দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা অন্তত ৪০০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু এর বিপরীতে গড়ে ২৭০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে, যার মধ্যে প্রায় ৯৭ কোটি ঘনফুট আমদানি করা এলএনজি।পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ২৫০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু কখনোই এই চাহিদা পূরণ করা যায় না। জ্বালানি সংকটের কারণে ছোট-বড় প্রায় ৩০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।আগামী মার্চে পিডিবি থেকে পেট্রোবাংলার কাছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১৬০ কোটি ঘনফুট মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা দেওয়া হয়েছে। তবে পেট্রোবাংলা বলছে, চাহিদার বিপরীতে সর্বোচ্চ ১২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাবে।তবে বাস্তবতা হলো, এই গ্যাস সরবরাহ করাও কঠিন হয়ে যাবে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে দেশে অনুসন্ধান অবহেলার কারণে পূরনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে দিনে উৎপাদন কমছে। আবার চাহিদা অনুযায়ী এলএনজি আমদানিরও সুযোগ নেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সক্ষমতার অভাবে। এর সঙ্গে ডলার সংকট তো রয়েছেই।গ্যাসের সংকট তীব্র হচ্ছে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে উচ্চদামের ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালাতে হবে। এতে করে সরকারের ব্যয় ও লোকসান বেড়ে যাবে। এ ছাড়া লোডশেডিং হলে মাঠপর্যায়ে সেচেও ডিজেলচালিত সেচপাম্পের খরচও বাড়বে।
সূত্র: দেশ রূপান্তর 

বাংলাস্কুপ/ডেস্ক/এনআইএন/এসকে


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স

প্রতিবেদকের তথ্য


এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ